আমরা শিশু জন্মের পর একবারও কি শিশুর আকিকার কথা ভাবি। অথচ আকিকার কথা ইসলামে গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে। রাসুল (স:) বিভিন্ন হাদীসে আকীকা দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। ইসলামি বিধানের আলোকে আকীকার বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:
আকিকার প্রয়োজনীয়তা :
ইসলামি বিধানে আকিকা করা মুস্তাহাব। তবে আমাদের দেশে অনেকে আকিকা গুরুত্বের সহকারে করে থাকেন। আবার অনেকে আকিকা করে না। বেশিরভাগ মানুষ আকিকা করা থেকে দূরে থাকেন। আবার আকিকা সর্ম্পকে যারা জানেন, তাদের আর্থিক অবস্হা ভাল না হওয়ায় এই কাজটি এড়িয়ে যান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক মুসলিম সন্তানের আকিকা করা উচিত। এতে করে ঐ শিশুর বালা মসিবত, বিপদ-আপদ দূর হয়।
ইসলামের পরিভাষায় সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ যে জন্তু যবাই করা হয় তাকে আকীকা বলা হয়। তবে সামর্থবান পিতার উপর সন্তানের আকিকা করা মুস্তাহাব।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘সন্তানের জন্য আকিকা করতে হয়। সুতরাং তোমরা তার পক্ষ থেকে জবাই কর এবং তার জঞ্জাল দূর কর। (অর্থাৎ মাথার চুল কামিয়ে দাও।)’ [সহীহ বুখারী: ২/৮২২]
কতদিনের মধ্যে আকিকা করতে হয়?
শিশু জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করা উত্তম। সপ্তম দিনে সম্ভব না হলে চৌদ্দতম দিনে করবে। তাও সম্ভব না হলে একুশতম দিনে করবে। হাদীস শরীফে এই তিন দিনের উল্লেখ আছে। কেউ যদি এ দিনগুলোতেও আকিকা করতে সক্ষম না হয় তাহলে পরবর্তী যে কোন সময়ে তা করে নিতে পারবে।
হযরত বুরাইদা রা. এর সূত্রে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আকীকার পশু সপ্তম বা চৌদ্দতম বা একুশতম দিনে যবাই করা হবে।’ [আলমুজামুল আওসাত ৫/৪৫৭]
রাসূলে পাক আরো ইরশাদ করেছেন, ‘যার সন্তান ভূমিষ্ট হয়, সে যদি শিশুটির পক্ষ থেকে আকীকা করা পছন্দ করে, তাহলে যেন তাই করে।’ [সুনান নাসায়ী: ২/১৬৭]
হযরত সামুরা বিন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক শিশু তার আকিকার বিনিময়ে বন্ধক স্বরূপ থাকে। কাজেই সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে জবাই করবে এবং তার মাথা মু-ন করে নাম রাখবে।’ [সুনান আবু দাউদ: ২/৩৯২]
হাদীসটির ব্যাখ্যায় ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেছেন, এটি আখেরাতে শাফায়াতের ব্যাপারে। যে সন্তানের আকিকা করা হয়নি সে যদি অপ্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় মারা যায় তাহলে মা-বাবার জন্য সুপারিশ করবে না।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. যাদুল মা‘আদে লিখেছেন- আকীকা শয়তানের কবল থেকে সন্তানের হেফাযত ও সুরক্ষার জন্য উপায় ও উসিলা হয়। আকীকা না করা হলে সন্তান শয়তানের প্রভাব মুক্ত হতে পারে না। এখানে ভুল মা-বাবার, কিন্তু মাশূল দিতে হয় সন্তানকে। এর আরো দৃষ্টান্ত আছে। মা-বাবা যদি সঙ্গমের পূর্বে বিসমিল্লাহ পড়ে নেয়, এবং এ সঙ্গম দ্বারা গর্ভ সঞ্চার হয়, তাহলে সে সন্তান শয়তান থেকে নিরাপদ হয়ে যায়। আর যদি বিসমিল্লাহ না পড়ে তাহলে সন্তানের এ নিরাপত্তা অর্জিত হয় না।
সপ্তাহের দিন মোট ৭ টি। একটি মানব শিশুর জীবন দীর্ঘ হতে থাকে আর এ দিনগুলোই ঘুরে-ফিরে বারবার আসতে থাকে। সপ্তম দিনে আকিকা করার মাধ্যমে সন্তানের আয়ুর ব্যাপারে একটি ‘শুভলক্ষণ’ গ্রহণ করা হয়। এ নবজাতক এভাবেই সপ্তাহের পর সপ্তাহ পার করতে থাকবে। আর তার হায়াত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকবে। ইসলামে শুভলক্ষণ গ্রহণ করা জায়েয। অশুভলক্ষণ গ্রহণ করা জায়েয নেই
আকিকার জন্য কী পশু হতে হবে :
আকিকার জন্তু কুরবানীর জন্তুর মতোই নির্দিষ্ট বয়সের হতে হবে। কুরবানীর জন্তু যেসব ত্রুটিমুক্ত হতে হয়, আকীকার জন্তুও সেসব ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। যে জন্তু দিয়ে কুরবানী করা জায়েয নেই, তা দিয়ে আকিকা করাও জায়েয নেই।
উত্তম হলো ছেলের আকিকায় দু’টি ছাগল যবাই করা এবং মেয়ের আকীকায় একটি। হযরত উম্মে কুরয কা‘বিয়া রা. বলেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘ছেলের জন্য সমপর্যায়ের দুটি ছাগল এবং মেয়ের জন্য একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করবে।’ [সুনান আবু দাউদ: ২/৩৯২]
‘সমপর্যায়ের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমদ রহ. বলেন, দেখতে উভয়টি একই ধরণের হবে। অথবা সে দু’টি একই বয়সের হবে।
হযরত উম্মে কুরয রা. আরো বলেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘ছেলের জন্য দু’টি ছাগল এবং মেয়ের জন্য একটি ছাগল জবাই করবে। আর এতে তোমাদের কোন ক্ষতি নেই-সেগুলো নর হোক কিংবা মাদী।’ [সুনান আবু দাউদ: ২/৩৯২]
অসচ্ছলতার কারণে পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে যদি দু’টি ছাগল জবাই করা কঠিন হয়, তাহলে একটি দিয়েও আকিকা আদায় হয়ে যাবে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হাসান রা. ও হযরত হুসাইন রা. এর পক্ষ থেকে একটি করে দুম্বা দিয়ে আকিকা করেছেন। [সুনান আবু দাউদ: ২/৩৯২]
আকিকার গোসত বিতরণের নিয়ম:
আকিকার গোসত কুরবানীর গোসতের মতোই। পরিবারের সবাই খেতে পারবে। আত্মীয়দের দিতে পারবে। গরীবদের খাওয়াতে পারবে। কাঁচা ও রান্না করা উভয়ভাবে বিতরণ করতে পারবে। এর দ্বারা আনুষ্ঠানিক আপ্যায়নের ব্যবস্থাও করতে পারবে। [রদ্দুল মুহতার: ৬/৩৩৫]
আকিকার গোসত মা-বাবাও খেতে পারবে কি না :
আমাদের সমাজের অনেকের ধারণা, পিতা-মাতা আপন সন্তানের আকিকার গোসত খেতে পারবে না। আবার যে সন্তানের আকিকা করা হচ্ছে, সেও নিজের আকিকার গোসত খেতে পারবে না। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ও অমূলক। এর পক্ষে কোন দলীল নেই। আগেও উল্লেখ করেছি। আকিকার গোসত কুরবানীর গোসতের মতো। পরিবারের সবাই খেতে পারবে।
Leave a Reply