পাশের বাসার বাচ্চার চিৎকার কানে ভেসে আসছে, তার চেয়েও বেশি শোনা যাচ্ছে অধৈর্য্য মায়ের আর্তি। মায়ের এক কথা, এত একরোখা কেন তার বাচ্চা।
আসলেই এখনকার বাচ্চারা অনেক বেশি এক রোখা আর জেদী। কেন? আমার মনে হয়, চার দেয়ালের মাঝে বাস করতে করতে তাদের পৃথিবী বিকশিত হতে পারছে না। বাবা মা রাস্তায় যে বের হবে বাচ্চা নিয়ে তারও জো নেই। ধুলা, বালি, গাড়ীর চাপ, বিল্ডিং তৈরির জন্য রড বালু সিমেন্ট রেখে রাস্তায় চলাই দায়, সেখানে বাচ্চা নিয়ে কেমনে বের হবে। আবার কিছুদিন পর পর রাস্তা খোড়াখুড়ি লেগেই আছে। মহল্লাগুলোতে নেই কোন ফাঁকা জায়গা বা খেলার মাঠ। স্কুল গুলোও মুরগির খাঁচা।
তাই বাধ্য হয়ে বাচ্চারা বড় হচ্ছে এক কিংবা দুই হাজার বর্গফুটের খুপরিতে। যেখান থেকে আকাশটাও তারা দেখতে পারে না। ভরসা টেলিভিশন, স্মার্ট ফোন কিংবা ডেক্সটপ বা ল্যাপটপ। বয়স আরো কম হলে, পুতুল কিংবা নানা ধরনের খেলনা। অনেক বাচ্চার বাবা মা দুজনেই চাকরি করেন। সারাদিন তারা যেমন পরিশ্রম করে দিন শেষে ক্লান্ত থাকেন, অন্যদিকে বাচ্চারাও তীর্থের কাকের মত বসে থাকে কখন বাবা মা আসবে। তাই তাদের আবদার থাকে একটু বেশিও। তখন দুই পক্ষই পড়ে সমস্যায়।
বেঁচে থাকার তীব্র প্রতিযোগিতায় আমাদের সামনে লক্ষ্য শুধুই টাকা। আসলে টাকারও তো দরকার। ঢাকায় মোটামুটি অবস্থায় থাকতে গেলেও তো এখন মাসে ৫০ হাজার টাকা লাগে। যারা একটু ভালো থাকতে চান, তাদের লাখ খানেক। বাচ্চার মায়া, আবেগ চিন্তা করলে কি টাকা আসবে?

আমাদের বাপ চাচাদের কথা ভাবুন। তাদের প্রায় সবাই গ্রামে কিংবা গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়েছেন। ৫/৬ ভাই বোন থাকতেন তারা। কেউ কেউ হয়তো ১০/১২ জনও থাকতেন। তাই ছোট বেলায় তাদের খেলার সাথীর অভাব হয়নি। দৌড়ে বাড়ি বাইরে চলে গেলে হারিয়ে যাওয়া, গাড়ী চাপ কিংবা ছেলে ধরার কোন ভয় ছিল না। সবাই এক সাথে খাওয়া দাওয়া, পড়ালেখা, শুয়ে থাকা, পুকুরে ঝাপাঝাপি-কত স্বাধীনতা ছিল তাদের।
কেউ তাদের বলতো না, এটা করিস না ওটা করিস, ওখানে জাস না। এগুলো বলার সময় কোথায়, তাদের মায়েরা মানে আমাদের দাদী কিংবা নানীরা ব্যস্ত থাকতেন গৃহ কাজে। দাদা কিংবা নানারা ব্যস্ত থাকতেন মাঠের কাজে। সূর্য ওঠার সময় তারা যেতেন অস্ত গেলে বাড়ি ফিরতেন। আবার পাশের বাড়ির চাচা, চাচীরা থাকতো তাদের ছেলে মেয়েরা থাকতো, সবাই মিলে বিরাট ব্যাপার। তাই হয়তো আমাদের বাপ চাচারা তাদের বাবাকে অতটা মিস করতো না, এখন আমাদের বাচ্চারা যতটা মিস করে।
সব কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু কর্পূরের মত উড়ে যাচ্ছে মানসিক শান্তি। আজ কেউই নিরাপদ না। রাস্তায় বের হলে নিশ্চয়তা দেয়া যায় না, শেষ পর্যন্ত বাসায় ফিরতে পারবো কিনা।
রাস্তাঘাটে মানুষে মানুষে আচরণ দেখে মনে হয়, আদৌ তারা মানুষ কিনা। নারীরা রাস্তায় বের হয়ে নিরাপদে চলতে পারবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। শিশুরাতো আরো ঝঁুকির মুখে। একজন ৫৮ বছরের মানুষ রূপী পশু যখন ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে তখন কেবলই, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
মনে হয়, এ কোন সময়ে, সমাজে বাস করছি আমরা। এভাবে আমাদের কতদিন চলতে হবে। আগে আমাদের শিক্ষার হার কম ছিল, আয়ও কম ছিল, এত প্রযুক্তি ছিল না, কই তখনতো এসব এত শোনা যেত না। আজকে আমরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না, কেন? এত এত অর্জন দিয়ে কী হবে যদি না আমরা মানুষ হতে পারলাম?
Leave a Reply